বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক আন্দোলন তরুণ সমাজের সাহস ও নিষ্ঠার এক অমর গাথা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোতে তরুণরা সবসময়ই অগ্রভাগে ছিল। তবে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব, যা "ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান" নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরুণ সমাজের অভূতপূর্ব ভূমিকার একটি নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। এই রচনায় জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরুণ সমাজের অবদান এবং তাদের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হবে।
জুলাই বিপ্লব ২০২৪: তরুণ সমাজের নেতৃত্বে এক গণ-অভ্যুত্থান
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন হিসেবে। জুন ২০২৪-এ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৮ সালের সরকারি সার্কুলার বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০% কোটা পুনর্বহাল করার রায় দেয়। এই রায়ের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করে। তবে, সরকারের কঠোর দমননীতি, যার মধ্যে ছিল পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের হামলা, এই আন্দোলনকে একটি পূর্ণাঙ্গ গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত করে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে সরকারের নির্মম দমন, যা "জুলাই গণহত্যা" নামে পরিচিত, শত শত প্রাণহানি এবং হাজার হাজার আহতের ঘটনা ঘটায়। এই সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৫০ থেকে ১৫০০ জন নিহত হয়, যার মধ্যে অনেক ছিল ছাত্র ও শিশু।
এই আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল তরুণ সমাজ, বিশেষ করে "বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন" নামে একটি সংগঠন। নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদের মতো তরুণ নেতারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্থানীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে আন্দোলনকে সংগঠিত করে। ৪ আগস্ট, ২০২৪-এ ছাত্ররা ঢাকার শাহবাগে জড়ো হয়ে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করে। পরদিন, ৫ আগস্ট, লক্ষ লক্ষ মানুষের "ঢাকায় দীর্ঘ পদযাত্রা" প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করে এবং তিনি ভারতে পালিয়ে যান। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরুণ সমাজের ঐতিহাসিক ভূমিকা
জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরুণ সমাজের ভূমিকা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য প্রাণ দিয়েছিল, যা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তরুণরা মুক্তিবাহিনী হিসেবে যোগ দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তরুণ সমাজ স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে। জুলাই বিপ্লব এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বহন করে, যেখানে তরুণরা শুধু প্রতিবাদই করেনি, বরং একটি স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
জুলাই বিপ্লবে তরুণ সমাজের অবদান
জুলাই বিপ্লবে তরুণ সমাজের অবদান বহুমুখী ছিল। প্রথমত, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী সমর্থন আদায় করে। #JulyMassacre এবং #RememberingOurHeroes-এর মতো হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে তারা আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, তরুণরা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী, এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো সংগঠনের সমর্থকরা ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে। তৃতীয়ত, তরুণরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ থেকে অসহযোগ আন্দোলন পর্যন্ত কৌশলগতভাবে আন্দোলন পরিচালনা করে, যা শেষ পর্যন্ত সরকারের পতন ঘটায়।
এই বিপ্লবে তরুণদের সাহসের প্রতীক ছিলেন আবু সাঈদের মতো ব্যক্তিত্ব, যিনি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। তার মৃত্যু জনতার মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং আন্দোলনকে আরও তীব্র করে। তরুণরা শুধু প্রতিবাদই করেনি, বরং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদের মতো ছাত্রনেতারা অন্তর্বর্তী সরকারে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যা তরুণদের রাজনৈতিক প্রভাবের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
তরুণ সমাজের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
জুলাই বিপ্লব তরুণ সমাজের ক্ষমতা প্রদর্শন করলেও, তাদের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনৈতিক দমন, সামাজিক অস্থিরতা, এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তরুণদের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়া, সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মতো কৌশল তথ্যপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করেছিল। তবুও, তরুণদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, বিশ্বায়নের সঙ্গে সংযুক্ততা, এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতি অঙ্গীকার তাদের অপরিসীম সম্ভাবনা দিয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পর তরুণরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ পুনরুজ্জীবিত করা, প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, এবং লিঙ্গ সমতার মতো বিষয়ে কাজ শুরু করেছে।
উপসংহার
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরুণ সমাজের অপরিহার্য ভূমিকাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে। এই বিপ্লব কেবল একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতনই ঘটায়নি, বরং গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়, এবং সুশাসনের জন্য তরুণদের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে। তবে, এই অর্জনকে টেকসই করতে হলে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, নিরাপত্তা, এবং সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজন। জুলাই বিপ্লব তরুণ সমাজের হাতে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ এনেছে, এবং তাদের ঐক্য ও দৃঢ়তা দেশকে একটি গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
Leave a Comment