ইরান-ইসরায়েল সাম্প্রতিক সংঘাত
২০২৫ সালের ১২ জুন থেকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইসরায়েল ইরানের নাতানজ ও ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি এবং উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC)-এর প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামি এবং সামরিক বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ হোসেইন বাঘেরি নিহত হন। ইরান প্রতিশোধ হিসেবে ১৩ জুন থেকে ইসরায়েলের প্রধান শহরগুলোতে শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, যাতে কমপক্ষে ২৪ জন নিহত এবং ২০০ জনের বেশি আহত হয়।
ইরানের সংসদ সদস্য এবং IRGC কমান্ডার এসমাইল কোসারি ১৪ জুন, ২০২৫-এ ঘোষণা করেন যে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা “গুরুতর বিবেচনাধীন” রয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাগচি এই হামলাগুলোকে “আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন” বলে অভিহিত করে প্রণালী বন্ধের হুমকি দেন। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে ইসরায়েলকে সহায়তা করলেও সরাসরি হামলায় অংশ নেয়নি। তবে, ২২ জুন, ২০২৫-এ যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে B-2 বোমারু বিমান দিয়ে হামলা চালায়, যা ইরানের প্রতিক্রিয়াকে আরও উত্তপ্ত করে।
ইরানের এই হুমকি কেবল কৌশলগত চাপ সৃষ্টির জন্য নয়, বরং তাদের কাছে ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, নৌ-মাইন, ড্রোন এবং দ্রুতগামী আক্রমণ নৌকার মতো অস্ত্র রয়েছে, যা প্রণালী বন্ধ করতে সক্ষম। তবে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রণালী বন্ধ করা ইরানের নিজের অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর হবে, কারণ তারা তেল রপ্তানির জন্য এই পথের উপর নির্ভরশীল।
বিশ্বের উপর প্রভাব
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বিশ্ব অর্থনীতি ও জ্বালানি বাজারে গভীর প্রভাব পড়বে। নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য:
- তেলের দামে উল্লম্ফন: প্রণালী বন্ধ হলে তেলের সরবরাহে তাৎক্ষণিক ঘাটতি দেখা দেবে, যা তেলের দামকে ব্যারেল প্রতি ১০০-১৫০ ডলারের উপরে নিয়ে যেতে পারে। ইসরায়েলের হামলার পর তেলের দাম ইতিমধ্যে ১৩% বেড়েছে। গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতে, দীর্ঘমেয়াদি বন্ধের ক্ষেত্রে দাম আরও বাড়তে পারে।
- বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দা: তেলের দাম বৃদ্ধি পরিবহন, শিল্প এবং ভোক্তা পণ্যের খরচ বাড়াবে, যা বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হতে পারে। এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে চীন, জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া, যারা প্রণালী দিয়ে আমদানি করা তেলের উপর নির্ভরশীল, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
- বাণিজ্য ব্যাঘাত: প্রণালী বন্ধ হলে সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল ও গ্যাস রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। বিকল্প পথ, যেমন কেপ অফ গুড হোপ, দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল, যা বাণিজ্য ব্যয় বাড়াবে।
- ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা: প্রণালী বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা, বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলো, সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারে। ইরানের প্রধান তেল আমদানিকারক চীন এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে পারে, যা বৈশ্বিক কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়াবে।
- জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতা: ইউরোপ, যা কাতার ও সৌদি আরব থেকে LNG এবং তেল আমদানি করে, শক্তি সংকটের মুখোমুখি হবে। এশিয়ার ৮০% LNG আমদানি প্রণালী দিয়ে আসে, যা বন্ধ হলে জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশের উপর প্রভাব
বাংলাদেশ, একটি তেল ও গ্যাস আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে গুরুতর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের মুখোমুখি হবে।
- জ্বালানি সংকট: বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে পরিশোধিত তেল এবং LNG আমদানি করে। প্রণালী বন্ধ হলে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং সরবরাহে ঘাটতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করবে। এটি লোডশেডিং বাড়াতে পারে, যা শিল্প উৎপাদন হ্রাস করবে।
- মুদ্রাস্ফীতি: তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বাড়বে, যা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (CPD) সতর্ক করেছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের কারণে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে।
- রপ্তানি শিল্পে প্রভাব: বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, যা অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি, কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানি পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাহাজের বীমা প্রিমিয়াম বৃদ্ধি এবং প্রণালীতে নৌযানের ঝুঁকি রপ্তানি প্রতিযোগিতায় বাধা সৃষ্টি করবে।
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ: জ্বালানি আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। ইতিমধ্যে তেলের দাম ৭% বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এটি টাকার মান কমিয়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
- পরিবহন ও বাণিজ্য ব্যয় বৃদ্ধি: বিকল্প সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচলের খরচ বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনে তেল পরিবহনের জন্য ফ্রেট রেট ২৪% বেড়েছে। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।
- সামাজিক প্রভাব: জ্বালানি ও পণ্যের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে, যা দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।
সমাধানের সম্ভাব্য পথ
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং হরমুজ প্রণালী বন্ধের সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:
- জ্বালানি বৈচিত্র্যকরণ: বাংলাদেশের উচিত সৌর, বায়ু এবং জলবিদ্যুৎ-এর মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসে বিনিয়োগ বাড়ানো। স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান ত্বরান্বিত করা আমদানি নির্ভরতা কমাতে পারে।
- কৌশলগত জ্বালানি মজুদ: জ্বালানির কৌশলগত মজুদ তৈরি করা, যা সংকটকালে ব্যবহার করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক এনার্জি এজেন্সি (IEA) সদস্য দেশগুলোর জন্য ৯০ দিনের আমদানি মজুদ বাধ্যতামূলক করে।
- আঞ্চলিক সহযোগিতা: ভারত, চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
- জ্বালানি দক্ষতা: শিল্প ও পরিবহন খাতে জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমানো। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে জ্বালানি খরচ কমানো সম্ভব।
- আন্তর্জাতিক কূটনীতি: যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিরসনে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। ইরানের পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবন সংঘাত কমাতে পারে।
উপসংহার
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের ফলে হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি বিশ্ব ও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। তেলের দাম বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, এবং জ্বালানি সংকট বাংলাদেশের শিল্প ও জনগণের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে। তবে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, জ্বালানি বৈচিত্র্যকরণ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সংঘাত নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা, যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ খোলা থাকে এবং বিশ্ব অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকে।
Leave a Comment